স্নেহাহারা—খুশিহারা, আমরা!
উজ্জ্বল মেহেদী
শ্রাবণ মেঘের দিন। মেঘমেদুরে দুই যুগ আগে এমনই এক দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। ছয়মাসে বাংলাদেশ চষে বেড়ানো চারণসাংবাদিক বেলাল বেগ সুনামগঞ্জ শহরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের সব জেলা শহর পরিস্থিতি দেখে দৈনিক পত্রিকায় পাতায় ‘পথে পথে’ কলাম লিখতেন। সংবাদের ঘনঘটার ভিন্নতায় বেলাল বেগের কলাম পাঠকপ্রিয় ছিল। ‘ভয়ঙ্কর চন্দ্রালোকে’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলেন প্রথম আলোর শেষপাতায়। সেদিন বেলাল বেগকে নিয়ে গণমানুষের নেতা বরুণ রায়ের বাসায় গিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাত।
শহরে তখন রাত যত বাড়তো, জেগে থাকতো লঞ্চঘাট। আমরা জেগে থাকতে লঞ্চঘাট হয়ে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম উকিলপাড়া পয়েন্টে। প্রেসক্লাবে যাব। পথে থেমে গেলেন বেলাল বেগ। ‘উকিলপাড়া’ উঁকি দিয়ে বলেন, ‘শহরটাতো উকিলের শহর!’ থামিয়ে দিতে বললাম, এ নিয়ে কিছু লেখার দরকার নেই। তাহলে আর পথ চলতে পারবেন না! তা সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, ‘শহর থেকে সূত্রপাত হওয়া সব সামাজিক আন্দোলনে তো উকিলরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাহলে উকিলের শহর বলা যাবে না কেন?’
আমরা তখন জোছনায় বুঁদ। আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে! আমরা ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখি রূপ’! শহরটিকে নতুন করে বলতে শুরু করেছিলাম ‘জলজোছনার শহর’। আগে বলা হতো ‘কবিতার শহর’। আরও আগে আউল—বাউলের শহর, হাসন রাজার শহর। তারও অনেক আগে শহরটা ছিল ‘ভিলেজ টাউন’। এক ব্রিটিশ পরিব্রাজকের বলা থেকে অতল হয়েছিল শহরটির আদিরূপ—কালিদহ। দহ—দমনে অথবা এক শহর এত নামায়ন এড়াতে বেলাল বেগকে উত্তর না দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, সত্যি তো! রাজনীতি থেকে সমাজ ও সংস্কৃতি, সবখানেই তো আছে উকিল—উপস্থিতি। তাহলে উকিলের শহর বলতে মানা কেন?
মানা না মানার মান্যতা থেকে দেখছি, জলবৎ তরলংয়ের মতো শহরটাতে উকিল নেতৃত্ব এখনো বলবৎ আছে। সঙ্গিসাথি অনেকেই উকিল। উকিলদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। বাড়বাড়ন্ত ধারায় সর্বশেষ জুলাই—আগস্ট বিপ্লবের পর দেখেছি, দেশজুড়ে মামলার বন্যা বয়ে গেলেও সুনামগঞ্জ শহরকেন্দ্রিক কোনো মামলা হয় নি। আইনজীবীরা আগ বাড়িয়ে আইন নিয়ে হোলি না খেলার আহবানে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সব সৃষ্টিতে সুখ থাকে না। এই সৃষ্টিতে কিন্তু সুবিশাল সুখ। লিখতে না পারি, কিন্তু সেই সুখ থেকে বলছি, শান্তি এবং প্রেমের শহর আমাদের সুনামগঞ্জ। তবে এই প্রেম কখনো কখনো নিকষিত হেম। এই তো সেদিন, সড়ক ভিজে গেছে শিক্ষার্থীদের তরতাজা রক্তে। আহা, অকালমৃত্যুর আহাজারি! কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেছি, স্নেহা—খুশির অকস্মাৎ অকাল বিদায়। কিন্তু ব্যবচ্ছেদে কেউ আসল জায়গায় নক করেনি। নিরাপদ সড়ক চাই, সড়ক নিরাপত্তার সাদাসিধে দাবিতে মাতম। কেউ বলল না, এই সড়কপথ এড়িয়ে চলতে। বিকল্পপথ সন্ধান করতে।
এড়িয়ে যেতে স্মৃতির পিঠে করে একটু বেড়িয়ে আসা যাক। সময়টা স্কুলগোয়িং। নাজমুল হক নামের আমাদের এক সহপাঠী স্কুলছাত্রকে একটি বাস পথের মধ্যে কেড়ে নেয়। ছাত্র—জনতা—শহরবাসী মিলে এক লহমায় শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছিল আস্ত বাসস্টেশনকে। অবাক করা বিষয়। তারুণ্য বা আঠারোয় কী না সম্ভব! সেই সড়কপথে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। মলিন হলে স্মৃতিস্তম্ভে গাথা প্রতিবাদ অমলিন। স্নেহা—খুশিদের বিদায়ে এমনটি না দেখা বিস্ময়কর। বিষাদেরও বটে! শহরপ্রেম—দেশপ্রেমে পলেস্তারায় ছাইচাপা পড়ে যাচ্ছে। নির্বিবাদী কিছু একটা তো হতেই পারতো। যেমনটি হয়েছিল নব্বই দশকের শেষভাগে ১৯৯৭ সালে।
সিলেট—সুনামগঞ্জ সড়কপথে পাগলা—দামোধরটুপিতে ঘটে যত সড়ক দুর্ঘটনা। একদিন পাগলাবাজারে এক যাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় একটি বাস। দানবীয় বাসকাণ্ডে দাঁনা বাঁধে আন্দোলন। গঠন হয় যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সুদীর্ঘ রোডমার্চ হয়। নেতৃত্বে ছিলেন একজন উকিল। আমাদের প্রিয়, প্রয়াত আইনজীবী হুমায়ূন কবীর জাহানুর ছিলেন আন্দোলনের সদস্য সচিব। আহবায়ক যথারীতি সেই সময়কার জনপ্রতিবাদের প্রবাদপ্রতীম জনপ্রতিনিধি প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীন। সুনামগঞ্জ শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার রোডমার্চ করে সড়ক নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়েছিল। তখনকার জাতীয় গণমাধ্যমে নিউজের পর সম্পাদকীয়ও হয়েছিল। সাধুবাদে বলা হয়েছিল, জনপ্রতিবাদ।
কোথায় গেল জনপ্রতিবাদের ধারা? এমন প্রশ্ন প্রহেলিকায় জুলাই—আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সেই সময়কার আমাদের একজন কলেজশিক্ষক গণিস্যার বলেছিলেন, ‘শহরটা মৃত’ মনে হচ্ছে। দশক—দেড়েকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের যাঁতাকলে এমনটি হয়েছে। মৃত শহরকে জাগাতে কিছু দিকনির্দেশন জনগণ কর্তৃক নির্ণীত হয়েছিল। এর প্রধানতম চিহ্ন ছিল শহরটার দক্ষিণ খোলা জানালায়। কী অশ্চর্য জলপ্রকৃতি আমাদের। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি! একদিকে সুরম্য নদী সুরমা, আরেকদিকে সুবিশাল হাওর। দক্ষিণ খোলা জানালায় জলপরিসরকে হত্যা করতেই ডুংরিয়া গ্রামের ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছিলেন পতিত ফসিল আমলা। মন্ত্রীমন্ত্রে সংকীর্ণতায় একের পর এক সরকারি স্থাপনা স্থাপিত হয়েছে একটি স্থানে। প্রতিহিংসায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ নামটি পর্যন্ত হরণ করে ফেলা হয়।
জীবনের সুবহে সাদিক থেকে সরকারের সকল সুযোগ—সুবিধা ভোগ করে অস্তাচলে পাওয়া গিয়েছিল আরেক আমলা—কামলা। তিনি এখন হাওয়া। তবে তার কূটচালে শান্তি—স্মৃতি তর্পণে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের এখন নতুন নাম। তবু জেলাবাসী, শহরবাসী চুপ। ‘আমি তোমারি নাম গাই, আমার নাম গাও তুমি…’ গানের এ কথার মতো হয়নি কিছুই। এক সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার অংশে হেলান দেওয়া এতকিছু! স্নেহা—খুশিদের অকাল মৃত্যু জানান দিল—এই সড়কপথ যান ও জনযন্ত্রণায় একদিন নরকে পরিণত করবেই! সড়ক নামের নরক এড়াতে করণীয় তাহলে কী?
এই ‘কী—এর উত্তর এখন একটাই। তা হলো এই লেখার সূচনা অংশে যে চরিত্র চিত্রিত হয়েছে, তারাই। মানে উকিল সমাজ। একজন জনবান্ধব আইনজীবীকে দেখলাম, নিজ এলাকায় জলোৎসব করতে। জলের জোয়ারে জনস্বার্থে আদালতের আশ্রয় তিনি নিতে পারেন। জানতেও জানাতেও পারেন। আদালতের আগ্রহে সিলেটে এরকম একটি উদাহরণ কিন্তু স্থাপিত হয়েছিল। রাজসাক্ষী হয়ে দেখেছিলামও। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে যখন বিরোধী রাজনৈতিক দলের দাপটে যখন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসছাড়া, তখন দা—উঁচিয়ে ছাত্রদলকে ছাত্রলীগের ধাওয়া করার সচিত্র সংবাদ পড়ে তখনকার মেট্রোপলিটন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুজ্জামান হিরো স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দিয়েছিলেন। সাহসী সেই আদেশে দা উঁচিয়ে ধাওয়া করে ছাত্রলীগের সকল ক্যাডার একেএকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে মুচলেকা দিয়েছিল। সেইসব মুচলেকার বিবরণ ছিল, ‘আমি… এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, কলেজ ক্যাম্পাসে কলম ব্যতীত কস্মিনকালেও আর কোনো অস্ত্র হাতে নেব না…!’
কলম একটি মোক্ষম অস্ত্র। সেই আবিষ্কারকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কলম এমনই মোক্ষম অস্ত্র যে, কর্ণপাত না করলে সর্বনাশ। সর্বময় কলম—অস্ত্র নিয়ে উকিলরাই জীবন ও মৃত্যুর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উচ্চকিত হতে পারেন। স্নেহাহারা—খুশিহারা আমরার হয়ে আদালতের আশ্রয়ে বলতে পারেন—এক সড়কে হেলান দেওয়া, এক জায়গায় স্থাপিত সকল সরকারি স্থাপনার ঠিকানা সুষম বন্টন করুন, সড়কপথে মৃত্যুঝঁকি এড়াতে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যান, স্নেহা—খুশিদের মৃত্যু থামান!
আর যদি উকিলরা না পারেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন আন্দোলনের নেতৃত্বের কেউ একজন আদালতের দৃষ্টিপাতে দাঁড়াতে পারেন। তা—ও যদি না হয়, শেষ ভরসাস্থল স্বয়ং আদালত। সড়কপথে জীবন ও মৃত্যুর শৃঙ্খলায় মাননীয় আদালতের কাছে হাতজোড় করা আর্জি, বিচারিক বোধ—সুবোধে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্নেহাহারা—খুশিহারার ভবিষ্যৎ হাহাকার রোধ হতে পারে।
স্বকাতরে শুনতে চাই, গোটা জেলার প্রাপ্যতায় প্রাপ্য সরকারি বড় বড় স্থাপনা কেন মহাসড়কের এক কিলোমিটার অংশে ঘাঁটি করে একটির পর একটি স্থাপিত হলো? সরকারি টাকায় কার ঘাঁটি, কার খুঁটি—কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শাও!